ইসমাইলি মুসলিম সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক নেতা ও বিশ্বখ্যাত সমাজসেবী যুবরাজ করিম আগা খান মারা গেছেন। তাঁর দাতব্য প্রতিষ্ঠান আগা খান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর।
প্রতিষ্ঠানটির বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, পর্তুগালের লিসবনে নিজ বাসভবনে শান্তিপূর্ণভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন আগা খান। মৃত্যুর সময় পরিবারের সদস্যরা তাঁর পাশে ছিলেন।
বিশ্বব্যাপী দাতব্য কাজ ও আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব
আগা খান ছিলেন ইসমাইলি মুসলিমদের ৪৯তম ইমাম, যাঁর বংশধারা সরাসরি মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর পরিবার থেকে এসেছে বলে দাবি করা হয়। তিনি বিশ্বব্যাপী অসংখ্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সাংস্কৃতিক প্রকল্প পরিচালনায় জড়িত ছিলেন।
আগা খান ফাউন্ডেশন পরিচালিত আগা খান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক উন্নয়নশীল বিশ্বে শত শত হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক প্রকল্প পরিচালনা করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, “তিনি যেভাবে চাইতেন, ঠিক সেভাবে ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে বিশ্বজুড়ে মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ চালিয়ে যাব।”
বিলাসী জীবন ও ঘোড়দৌড়ে আগ্রহ
সুইজারল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করা এই সমাজসেবী ছিলেন যুক্তরাজ্যের নাগরিক। তিনি মূলত ফ্রান্সের একটি শ্যাটোতে (প্রাসাদসদৃশ পল্লিনিবাস) বসবাস করতেন।
বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার নেতৃত্ব দিলেও তাঁর বিলাসী জীবন নিয়েও আলোচনার কমতি ছিল না। তাঁর ছিল বাহামায় একটি ব্যক্তিগত দ্বীপ, অত্যাধুনিক প্রমোদতরি ও ব্যক্তিগত উড়োজাহাজ।
আগা খান ছিলেন যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও আয়ারল্যান্ডের ঘোড়দৌড়ের শীর্ষস্থানীয় মালিকদের একজন। তিনি একসময় বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান রেসের ঘোড়া শেরগারের প্রজনন করিয়েছিলেন।
রাজপরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক
আগা খান ছিলেন যুক্তরাজ্যের রাজা তৃতীয় চার্লস ও প্রয়াত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁর মৃত্যুর খবর রাজপরিবারকে জানানো হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, রাজা ব্যক্তিগতভাবে তাঁর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের শোকবার্তা
আগা খানের মৃত্যুতে বিশ্বজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ শোকবার্তায় তাঁকে “দূরদর্শী, বিশ্বাসী, উদার ও অসাধারণ নেতা” হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
আগা খান ফাউন্ডেশনের আওতায় ভারতের দিল্লিতে হুমায়ুনের সমাধিস্থল পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। বিশ্ব স্থাপত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে আগা খান পুরস্কার প্রদান করা হয়, যা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ।
এ ছাড়া তাঁর প্রতিষ্ঠিত আগা খান নেশন মিডিয়া গ্রুপ পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকার বৃহত্তম স্বাধীন গণমাধ্যম সংস্থা হয়ে উঠেছে।
বিশ্বের ইসমাইলি সম্প্রদায়ের শোক
বিশ্বজুড়ে ইসমাইলি সম্প্রদায়ের প্রায় দেড় কোটি সদস্য রয়েছে, যাঁদের মধ্যে পাকিস্তানে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করে। তাঁদের জন্য এটি এক যুগান্তকারী ক্ষতি।
১৯৫৭ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি ইসমাইলি সম্প্রদায়ের ইমামত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বে এই সম্প্রদায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও দাতব্য কর্মকাণ্ডে বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
ব্যাপক সম্পদের মালিক
ফোর্বস ম্যাগাজিনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে আগা খানের সম্পদের পরিমাণ ছিল প্রায় ১০০ কোটি ডলার। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পদের পাশাপাশি ঘোড়ার খামার ও ব্যবসায়িক উদ্যোগের ফলে তাঁর সম্পত্তি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাঁর দাতব্য ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। তাঁর চলে যাওয়া বিশ্বজুড়ে মানবহিতৈষী কাজের এক অসাধারণ অধ্যায়ের সমাপ্তি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।